ছোটবেলায় আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল - "ছোটবেলার আগের বছর থেকে"। এটা অনেক দিনের পুরনো কিছু বোঝাতে ব্যবহার করতাম। রবি বাবুর সাথে আমার সম্পর্কও ও রকম, মানে ছোটবেলার আগের বছর থেকে। না না, আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই, রাবীন্দ্রিক নই, শুধুই তাঁকে ভালবাসি, তাঁর লেখায়, তাঁর গানে, তাঁর কথায় মুগ্ধ হই। আর সেটা সেই ছোটবেলা থেকেই। একসময় গান শিখতাম। শুরুটা "ওগো নদী আপন বেগে ..." দিয়ে। পরে অবশ্য নদী আপন বেগে চলতে চলতে সাগরে মিশে গেছে, কিন্তু আমার আর গান শেখা হয়নি। দেশে থাকতে অনেক প্রিয় শিল্পী ছিল, অথবা বলা যায় কারও কারও কণ্ঠে কিছু কিছু গান ভালো লাগত। পঙ্কজ মল্লিকের গলায় "দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায়" এখনও কানে বাজে। তেমনি ছিল কে এল সায়গল, অশোকতরু বন্দ্যপধ্যায়। প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত, চিন্ময়, সাগর, দ্বিজেন, সুচিত্রা, কনিকা। তবে দেবব্রত বিশ্বাসের একটা বিশেষ জায়গা ছিল মনের কোনায়। বিশেষ করে "আছে জন্ম আছে মৃত্যু", "মেঘের পরে মেঘ জমেছে", "জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে" ইত্যাদি গানগুলো তাঁর কণ্ঠে এক ভিন্ন শিহরণ জাগাত। তবে এটা একান্তই ব্যক্তিগত। আমার কেন যেন মনে হয় অনেক কিছুর মতই স্বাদ, সুর, গন্ধ - এসব কিছুরই কোয়ান্টাম নম্বর আছে। অনেক সময় আপ্রিকট খেতে গিয়ে বেলের স্বাদ পাই বা আপেলে বাড়ির কোন আমের গন্ধ। আসলে সবই তো মিথস্ক্রিয়া। রেকর্ড তো একই ভাবে বাজে সবার জন্য, তবে কোন একটা সুর, একটা গান একজনের মনে যতটা দাগ কাটে অন্যজনের মনে ততটা নয়। ছবির ক্ষেত্রেও তাই। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে একই জায়গায় কয়েকটা ছবি তুলে বাছতে গিয়ে দেখা যায় একটা অন্যটার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে। অর্থাৎ টেকনিক্যালি একরকম হলেও একটা ছবি মনে অনুনাদ সৃষ্টি করছে এক অজানা কারণে। গান, গানের কথা, সুর - এসবও তাই। এখন সময়ের সাথে সাথে প্রিয় শিল্পীরা বদলে গেছেন। ইদানীং শ্রীকান্ত আচার্য আর জয়ীতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত তুলনামুলকভাবে বেশি শোনা হয়, যদিও এর বাইরেও অনেক পছন্দের শিল্পী আছে, শুনি। তবে আজ বলছি আশির দশকের কথা। "ঠাকুরবাড়ী" চণ্ডালের প্রবেশাধিকার না থাকলেও ও বাড়ির রাজপুত্রের আমার ঘরে ছিল অবাধ যাতায়াত। দিনের পর দিন ও থাকত আমার ঘরে। গান শুনে, গল্প করে আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে (অবশ্য ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুজনেই ছিলাম উদাসীন, তাই স্বপ্ন দেখা হত বা ভাবা হত ভাবতে হয় বলে। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা না যত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল আমাদের বন্ধুরা)। ওর ঠাকুরমার ঝুলিতে থাকত অনেক অনেক গান। আমার দেবব্রতের পর ওর সুবিনয়ের সুরেলা বিনয়ী কণ্ঠে ভরে উঠত রাতের বাতাস। সে এক অন্য রকম অনুভূতি, অন্য ভাবে রবি ঠাকুরকে পাওয়া।
No comments:
Post a Comment