Saturday, August 24, 2019

নক্ষত্রের বিদায়

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে কাছ থেকে প্রথম দেখি ১৯৮১ সালে। যদিও এর আগে তাঁর নাম শুনেছি, বিভিন্ন নির্বাচনের পোস্টারে তাঁকে দেখেছি। ১৯৮১ সালে উনি ছিলেন বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। আমি তখন ছাত্র ইউনিইয়ন করি, তাই তাঁর পক্ষে গ্রামে প্রচার চালাই। উনি এসেছিলেন মানিকগঞ্জ এক জনসভায়। কলেজের মাঠে। লোকজন যে খুব বেশি হয়েছিল তা নয়,তবুও আমরা এর মধ্যেও আশার আলো দেখেছিলাম। খুব কাছ থেকে কথা বলার সুযোগও হয়েছিল।

১৯৮৩ সালে আমি মস্কো আসি। অনেক বার তিনি এদেশে এসেছেন, বিভিন্ন সময় দেখা হয়েছে, কিন্তু সিপিবির নেতা কর্মীদের সাথে যতটা মিশেছি, তাঁর সাথে সেভাবে হয়নি। দোষটা আমাদেরই। তখন বিভিন্ন ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্ররা পড়তে আসত। সরকারী বৃত্তিতে খুব বেশি আসত না, বেশির ভাগ আসত ন্যাপ, সিপিবি, বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, বাকশাল - এ সব মস্কো ঘেঁষা রাজনৈতিক এবং গণ সংগঠনের মাধ্যমে। দেশে সিপিবি ও ন্যাপ হাতে হাত রেখে লড়াইয়ের মাঠে থাকত। কথা ছিল এদের মাধ্যমে আসা ছাত্ররা এ দেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ফিরে দেশ গড়বে। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে এ দেশে পা দেওয়ার সাথে সাথেই একে অন্যের আদর্শিক শত্রুতে পরিণত হত, আর এ কারণেই ওনার সাথে আমাদের যতটুকু যোগাযোগ হওয়ার কথা ছিল, ওনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যতটুকু জানা বা শেখার কথা ছিল সেটা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বা পীর হাবিবুর রহমান যখন এসেছেন তখন এ সমস্যা হয়নি। আসলে এ ছিল যতটা না ন্যাপ -সিপিবির দ্বন্দ্ব, তার চেয়ে বেশি এখানে যারা ন্যাপ ও সিপিবির মুখপাত্র ছিলেন তাদের ক্ষমতার লড়াই।

আসলে আমার মনে হয় এটা আমাদের দেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত রাজনীতির সমস্যা। উচ্চ মধ্যবিত্ত বলতে আমি বোঝাচ্ছি বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের সেই অংশকে যারা শুধু এ ঘরানায় আছেন বলেই নিজেদের মহাজ্ঞানী মনে করেন, ফলে সাধারণ মানুষের কথা বলে রাজনীতি করলেও তাদের পালস ঠিক বুঝতে পারেন না। এখানে ত্যাগী নেতা কর্মীর অভাব ছিল না, কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান বা মৌলানা ভাশানীর মত ক্যারিস্ম্যাটিক নেতা ছিলেন না যাদের ডাকে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হবে। তবে এই না থাকার মধ্যেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। তাঁর ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র কমিউনিস্টদের তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রের ডাকের চেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে বেশি প্রণিধান যোগ্য ছিল। ধর্ম যেখানে ডগমা আর পরকালের সুখের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, কী গণতন্ত্র কী সমাজতন্ত্র সেখানে ইহকালে সুখের সন্ধান করে - সেদিক থেকে ধর্ম আর সমাজতন্ত্র দুটো আন্টাগনেস্টিক ধারণা। তাই হয়তো তাঁর ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্রের শ্লোগান কমিউনিস্টদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তবে আমাদের দেশের সার্বিক বাস্তবতায় তাঁর রণকৌশল নিঃসন্দেহে বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে।

বাংলাদেশ আজ রাজনীতির বন্ধ্যা ভূমি, বধ্য ভূমি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ার পরেও দেশের এই অবস্থায় তাঁর উপস্থিতি আশা ব্যঞ্জক ছিল। মনি সিংহ, কমরেড ফরহাদের পর উনি ছিলেন এই ঘরানার রাজনীতির লাল ঝাণ্ডা। আজ দেশের গৌরবময় রাজনীতির আকাশ থেকে আরও একটি নক্ষত্রের পতন ঘটল।


দুবনা, ২৪ আগস্ট ২০১৯


No comments:

Post a Comment