২০১১ সালে প্রায় ১৪ বছর পরে যখন দেশে বেড়াতে যাই অনেক কিছুর সাথে যে
জিনিসটা খুব অবাক করেছিল সেটা হল প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি গাছে গাছে শত শত পোস্টারের
ঝুলে থাকা। দেশটা যেন এক বিশাল সাইনবোর্ড আর চারিদিকে সিনেমার বিজ্ঞাপন। এই পোস্টারের পেছনে যত খরচ সেটা যদি কোন
সেবামূলক খাতে ব্যয় করা হয় তা এসব দল বা প্রার্থীর পজিটিভ ইমেজ তৈরিতে অনেক বেশি কার্যকর
হবে বলেই আমার বিশ্বাস। কেননা সেবামূলক কাজ করতে মানুষের কাছে যেতে হয়, তাদের সাথে
কথা বলতে হয়। পোস্টার চমক দিতে পারে, সম্পর্ক তৈরি করে না। তাছাড়া প্রার্থী তো আর রেডিও,
টেলিভিশন, শাড়ি, গয়না বা কোন শৌখিন জিনিস নয় যে অ্যাড দিয়ে বিক্রী করতে হবে? তখন এটাও মনে হয়েছিল যে সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন
সিনেমা পর্যন্ত রিলিজ পাবে যেখানে প্রার্থী নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করবে। তবে আইফোন আর
স্মার্টফোনের যুগে সেটার আর দরকার হয় না। এরা সবাই অন লাইন ভিডিও রিলিজ করেই কাজ
চালায়।
কয়েকদিন আগে এক বন্ধু ফেসবুকে একটা লিংক পাঠিয়ে অ্যামেরিকা থেকে ফোন করে বলল
কয়েকদিন আগে এক বন্ধু ফেসবুকে একটা লিংক পাঠিয়ে অ্যামেরিকা থেকে ফোন করে বলল
-
পোস্টারটা দেখলি?
-
হুম?
-
কি বলিস?
-
কি আর বলব? তবে আইডিয়াটা খুব ভালো বলে
মনে হচ্ছে না।
না, নতুন কিছুই
নয়। একেবারে ক্ল্যাসিক্যাল পোস্টার। ছোটবড় বিভিন্ন নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট এক
সুদর্শন যুবক স্বপ্নিল চোখে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। না সে কিছু চাইছে না। স্থানীয় জনগণ চাইছে তার
কাঁধে এলাকার উন্নয়নের জোয়াল তুলে দিতে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ, এই সুদর্শন
যুবক আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এই পোস্টার
দেখে আমার দুটো গল্প, দুটো ছবির কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় বাড়িতে একটা ছবি ছিল
যেখানে হিমালয়ের ওপারে আকাশ থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর প্রশান্ত দৃষ্টিতে
নীচে এক ভক্তের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁদের ডান হাত থেকে নির্গত আলো আশীর্বাদ হয়ে
পড়ছিল সেই ভক্তের উপর। দেশে এখনও কারো হাত থেকে এভাবে আশীর্বাদ বর্ষিত হয় না, হলেও
সেটা হয় অদৃশ্যে একেবারে ভিন্ন রূপে। আবার এও হতে পারে অন্য সব কিছুর মত আজকাল
আশীর্বাদেরও নগদীকরণ বা মুদ্রায়ণ ঘটে গেছে। দ্বিতীয় যে ছবিটা মনে ভেসে উঠলো সেটা রুশদেশের
উপকথার শালগম (আসল নাম রেপকা) নামে গল্পটি যেখানে দাদু, দিদা, নাতনি মাশা, কুকুর
ছানা, বিড়াল ছানা আর সব শেষে ছোট্ট ইঁদুর একে অন্যকে ধরে টানছে এক বিশাল শালগম তোলার
জন্য। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের অংশগ্রহণেই শালগম উঠে আসে মাটি থেকে। তাকেই
বিজয়ীর ভুমিকায় উল্লাস করতে দেখি আমরা। বর্তমানের পোস্টারগুলোয় আসল লোকও থাকে সেই
ইঁদুরের ভুমিকায়। অন্যদের ভুমিকায় পছন্দ অনুযায়ী সেট বেছে নেওয়া যায়। বর্তমানে
জনপ্রিয় তিন সেটের মধ্যমণি জাতির পিতা, স্বাধীন দেশে বিশ্বাসঘাতকদের পুনর্বাসনকারী
এবং বিশ্ব বেহায়া। এর সাথে আরও নতুন কোন
সেট যোগ হবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।
ছবিটা দেখে
আমার মনে পড়ে গেল ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিনস্কে আমাদের প্রথম পরিচয়ের কথা।
পরে মস্কোয় একসাথে অন্তহীন সময় কাটানোর মুহূর্তগুলো সিনেমার মত একের পর এক ভেসে
গেল মনের পর্দায়। ও এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সম্মানের সাথে নিজ পেশায় কাজ করছে। সেই
সাথে সমাজ সেবাও করছে অক্লান্ত ভাবে। যাকে বলে নিজের আলোয় আলোকিত। দেশে অনেক মানুষ
ওর আশীর্বাদপুষ্ট। তাই ওকে অন্যের আলোয় আলোকিত হতে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারলাম
না। সাথে সেই প্রশ্ন – এই যে মানুষগুলো ওকে সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা
কি চায়? স্বাভাবিক ভাবেই তারা চায় যোগ্য ও সৎ নেতা। কিন্তু সেটা তো সবার চাওয়া। আর
এটাও সবার জানা বর্তমানে রাজনীতি যে পথে যাচ্ছে তাতে সৎ থাকা মানে স্রোতের বিপরীতে
যাওয়া, মানে অনেক প্রতিশ্রুতি পালন না করা। আর সব চেয়ে বড় কথা বর্তমানে রাজনীতিতে
সাফল্য যতটা না নির্ভর করে নিজের সদিচ্ছা আর যোগ্যতার উপর তার চেয়ে বেশি নির্ভর
করে পোস্টারের উপর থেকে তার দিকে সহাস্যবদনে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর মর্জির উপর। সেদিক
থেকে দেখলে কাজের ক্ষেত্রে নিজের স্বাধীনতা অনেকটাই কমে যায়। আর পরাধীন মানুষের
সীমাবদ্ধতা কে না জানে! আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ভালো কিছু করার জন্য দল নয়, দরকার ইচ্ছা আর সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন
করার জন্য প্রচেষ্টা। আমার বন্ধু এতদিন পর্যন্ত সে কাজটা বেশ সাফল্যের সাথেই করে
আসছে, আমার বিশ্বাস সে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি না হয়েই সাধারণ মানুষের সেবা
বরং আরও ভালো ভাবে করতে পারবে। তবে এটা আমার ইচ্ছা। ক্ষমতা চলে নিজস্ব নিয়মে।
ক্ষমতার মাধ্যাকর্ষণ বল বন্ধুর মাধ্যাকর্ষণ বলের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, বিশেষ করে
বন্ধু যদি ভরহীন আর ভারহীন হয়। তবে ক্ষমতার অন্ধ আকর্ষণের বিপরীতে মানুষের থাকে
সচেতনতা, থাকে শুভ বুদ্ধি। সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
দুবনা, ২৮
জানুয়ারি ২০১৯
No comments:
Post a Comment