তিন যুগেরও বেশি সময় কেটে গেল রাশিয়ায়। প্রথমে পড়াশুনা তারপর কাজ। সে সূত্রে আমার ওঠাবসা মূলত একাডেমিক ফিল্ডের লোকজনের সাথে। একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে যত বড় পোস্টেই থাকুক না কেন সে যার সঙ্গে কথা বলছে সেটা করছে যথেষ্ট সম্মানের সাথেই। এখানে অবশ্যই ঝগড়াঝাঁটির কথা হচ্ছে না, এমনিতে কোন কথাপোকথন। একজন প্রফেসর হাসিমুখে একজন সুইপারের সাথে কথা বলছে নিজের বা সুইপারের সামাজিক অবস্থানের কথা না ভেবেই। আবার সুইপারও প্রফেসরের সাথে কথা বলতে গিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে না। আসলে পেশা বা পদ কেউ পকেটে করে ঘুরে বেড়ায় না। কাজের সময় কেউ প্রফেসর, কেউ সুইপার, কেউ বা অন্য কিছু, কিন্তু কাজের বাইরে সে অন্য দশ জনের মতই একজন মানুষ। এখানে একই বিল্ডিঙে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, সুইপার, ব্যবসায়ী - বিভিন্ন পেশার লোকজন বাস করে। লিফটে বা নীচে দেখা হলে হাই হ্যালো করে। ইদানীং অবশ্য অনেকেই নিজের বাড়িতে থাকছে। সে যাই হোক, সম্পর্ক আমাদের দেশের মত অত দহরম মহরমের না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরস্পরের প্রতি সম্মানজনক। আমার বিশ্বাস পশ্চিমা বিশ্বেও তাই।
প্রাচীন ভারতে বর্ণ প্রথার ফলে সব মানুষ নিজ নিজ সামাজিক অবস্থান সাথে করে ঘুরে বেড়াত। ফলে কথাবার্তা, খাওয়া দাওয়াসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে ছিল বিভিন্ন রকমের বিধিনিষেধ। সেখানে ইসলাম ছিল যথেষ্ট প্রগতিশীল। কিন্তু দীর্ঘ দিন এদেশের আলো হাওয়ায় উপমহাদেশের ইসলামও বর্ণ প্রথার দোষে দোষী হচ্ছে বলে মনে হয়। আমার কেন যেন মনে হয় বর্ণ প্রথা এটা প্রাচীনতম আমলাতন্ত্র। আমলারাও তাদের পদটাকে বর্ণের মত পকেটে করে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদের সাথে কথা বলে অহংকারের সাথে। এটা যে রাশিয়া বা পশ্চিমা দুনিয়ায় নেই তা নয়, তবে আমাদের সব দেশে সেটা শুধু আমলাদের মধ্যে নয়, সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা যারা বিভিন্ন বড় বড় আদর্শের বুলি ছাড়ি, তাদের বেশির ভাগই সেসব আদর্শ ধারণ করি না। অনেকেই অনেক কিছু করি লোক দেখানোর জন্য, সমাজে নিজের অবস্থান পাকা করার জন্য। এটা নিজের মানসিক উৎকর্ষ সাধন নয়, বাহ্যিক আবরণ আর আভরণ। একটু পড়াশুনা শিখলেই আমরা নিজেদের উপর তলার মানুষ বলে মনে করি। সেই সাথে ভাল চাকরি, টাকাপয়সা আমাদের অহংকার আরও বাড়িয়ে দেয়। কে জানে এর পেছনে আমাদের হাজার বছরের বর্ণ প্রথা আছে কিনা!
No comments:
Post a Comment