আমার
ছোটবেলা কেটেছে মায়ের মুখে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প আর পাঁচালী শুনে। সাথে ছিল
ঠাকুরমার ঝুলি। আমার জন্মের সময় বাবার বয়স ৫৬, মার বয়স জানি না, তবে খুব কম ছিল
না। ফলে ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দাদু বা দিদিমা – এদের কারোই সৌভাগ্য হয়নি আমাকে দেখে
যাওয়ার। জানি না, রুশ দেশের বিভিন্ন গল্প মা’র পড়া ছিল কি না, তবে পরে তাঁর অনেক
গল্পের মাঝেই এদেশের গল্প খুঁজে পেয়েছি। সন্ধ্যে হলেই সবাই মিলে বসতাম বড়দার
বারান্দায়। সারাদিনের রোদ গরম করে রাখত দখিনমুখি সেই বারান্দাটা। শুরু হত “ভব সাগর
তারণ কারণ হে” সহ বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান দিয়ে, তারপর আমাদের শাস্তর (শাস্ত্র)।
অনেক সময় ছোট কাকাও যোগ দিতেন এই গল্প আর গানের আসরে। স্বাধীনতার পরে বাড়িতে আসতে
শুরু করে রুশ দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা। এক সময় রুশ দেশের উপকথা বইটাও হাতে আসে।
এরপর পাই মালাকাইটের ঝাঁপি, উভচর মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে অর্থে অন্যান্য অনেকের
মতই আমার কৈশোরের একটা বিরাট অংশ কেটেছে রুশ দেশের বিভিন্ন বই পড়ে। দেশীয় যে ছিল
না, সেটাও নয়। এছাড়া ছিল বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি দেশ বিদেশের রচনা সমগ্র।
তবে আমি ছোটদের বইয়ের আসল স্বাদ পাই বাবা হয়ে। বাচ্চারা ছিল আমার ন্যাওটা, তাই আমি
বই না পড়লে বা গল্প না বললে ঘুমুতে চাইত না। আমিও প্রথম প্রথম রামায়ণ মহাভারতের
গল্প দিয়েই চালিয়ে দিতাম, তারপর এলো ভ্লাদিমির সুতেয়েভ, আগ্নেয়া বারতো, ইয়েভগেনি সভারস,
মিখাইল জশেঙ্কো, করনেই চুকভস্কি, এদুয়ারদ উসপেনস্কি, নিকোলাই নোসভ, আলেক্সান্দার ভোলকভ,
সামুয়েল মারশাক আরও কত নাম। এক সময় দেখা গেল যতটা না বাচ্চাদের জন্য তার চেয়ে বেশি
নিজের তাগিদেই পড়ছি বইগুলো। মনে হত বাড়ির ভাস্তে ভাইজিদের কথা যারা বিশ্ব শিশু
সাহিত্যের এক বিশাল ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কত রকমের আজগুবি গল্প অথচ মনে হত
এসব আমাদের সাথেই ঘটে যাওয়া। বিশেষ করে ভালো লাগত নিকলাই নোসভের গল্পগুলো - কী ফান্তাজিওরী (স্বপ্নদর্শীরা), নিজনাইকা (যে কিছু জানে না) কে নিয়ে বিভিন্ন গল্প। অনেক
সময় মনে হয়েছে কিছু কিছু অনুবাদ করার, কিন্তু কাজটি কখনই শুরু করা হয়নি। একটা কারণ
ছিল এমন যে আমাদের দেশে ভালো অনুবাদ বলতে যা বোঝায় সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি বা
রাদুগা প্রকাশনের বাইরে তেমন আছে বলে জানা নেই, অন্তত আমার কৈশোরে সেটা তেমন ছিল
না। সে থেকে অনুবাদ করার ইচ্ছে। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ায় যারা এ কাজটি
করেন তারা নিজেরাই সাহিত্যের দিকপাল। যেমন শেক্সপীয়ারের অনুবাদ করেছেন বরিস
পাস্তেরনাক নিজে, করেছেন মারশাক এবং আরও অনেকে। অর্থাৎ অনুবাদ যারা করেছেন তারা
অনেকেই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, কবি। তাই
ইচ্ছে থাকলেও সাহস হয়নি সেটা করার। তবে এর মধ্যেই কাজটি শুরু করেছে প্রিয় জাহীদ
রেজা নুর, মশিউল আলম ববি – দুজনেই অনুজ ও বন্ধু। জাহীদের অনুবাদে শিশু কিশোরদের সাহিত্য
ভাণ্ডার যেমন পরিপূর্ণ হয়েছে, ববির করা দস্তয়েভস্কীর সাদা রাত তেমনই আমাদের অনুবাদ
সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে। বইমেলা শেষের পথে, তবে বই আর পাঠক মেলার সাথে সাথেই হারিয়ে
যাবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। আপনারা এই বইগুলো কিনবেন, পড়বেন – রাশিয়ার সাহিত্যের
সাথে নতুন করে পরিচিত হবেন সেটাই আশা করি।
দুবনা, ২৭
ফেব্রুয়ারি ২০১৯
No comments:
Post a Comment